কিছুদিন আগে আমার সদ্য এসএসসি পাস করা মেয়ে আমাকে হঠাত্ বলল একটি টেলিটকের সিমকার্ড কিনে আনতে। সে বলল, এখন টেলিটকের সিমের মাধ্যমে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে যেকোনো শিক্ষার্থী যেকোনো কলেজে ভর্তির আবেদন ঘরে বসেই করতে পারছে। তখন আমার মনে পড়ল, আমাদের সময় কলেজে ভর্তির আবেদন করার জন্য কত ঝামেলাই না পোহাতে হতো। আমরা প্রত্যেকটি কলেজে যেয়ে যেয়ে আবেদন জমা দিয়েছি, আলাদা আলাদা ফরম কিনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ফর্ম জমা দিয়েছি। খরচ আর ভোগান্তির তো কোনো শেষই ছিল না। অথচ আজকাল এসব কত সহজ হয়ে গিয়েছে, সেবা পৌঁছে গিয়েছে জনগণের দোরগোড়ায়।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দিন বদলের সনদ হিসেবে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রথমদিকে কেউ কেউ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিষয়টিকে ঠিকমতো বিশ্বাস করেনি, বরং কারো কারো মনে এটি নিয়ে সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম বিষয়টিকে আস্থার সঙ্গে নিয়ে এ ঘোষণার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করেছিল। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিষয়টি উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া নয়, বরং তৃণমূল থেকে উঠে আসা একটি বিষয়। এরফলেই ডিজিটাল বাংলাদেশ যে একটি মিথ নয়, তা-ই এরমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে।
অনলাইনে দরপত্র জমা দিতে ঠিকাদারদের জন্য চালু করা হয়েছে ই-প্রকিউরমেন্ট। এখন অনেক মন্ত্রণালয় অনলাইনে দরপত্র আহ্বান করছে। এতে টেন্ডার বাণিজ্য রোধে এ ধরনের উদ্যোগ ভূমিকা রাখছে। আদালতের কার্যক্রমকে ডিজিটালাইজ করতে চালু হয়েছে মোবাইল কোর্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম। স্বল্প পরিসরে চালু হওয়া এ উদ্যোগের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালতের যাবতীয় ডক্যুমেন্ট অনলাইনে সংরক্ষণ এবং ব্যবহারের জন্য রাখা হচ্ছে। ভূমি মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন ও এটুআই প্রকল্পের যৌথ উদ্যোগে সকল রেকর্ড এসএ, সিএস, বিআরএস ও খতিয়ান কপি ডিজিটালাইজড করা হচ্ছে। এরমধ্যে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি খতিয়ান ডিজিটালাইজড করা হয়েছে। খুব শীঘ্র চালু হতে যাচ্ছে ডিজিটাল রেকর্ড রুম। এরমধ্যে ২৩ লাখ ২০ রেকর্ড ডিজিটাল সিস্টেমে প্রদান করা হয়েছে।
উদ্ভাবনকে উত্সাহিত করার জন্য এবং উদ্ভাবনী ধারণাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য এটুআইয়ের উদ্যোগে তৈরি হয়েছে সার্ভিস ইনোভেশন ফান্ড। বাংলাদেশের সকল পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গ নাগরিক সেবা গ্রহণে মাত্রাতিরিক্ত ধাপ কমিয়ে বা প্রযুক্তির ব্যবহার করে সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সময়, অর্থ ও যাতায়াতের পরিমাণ হ্রাস করা যায় এমন উদ্ভাবনী উদ্যোগসমূহ বছরের যেকোনো দিন যেকোনো সময় একটি সহজ উপায়ে অনলাইনে জমা দিতে পারেন। একটি নিরপেক্ষ বাছাই পদ্ধতির মাধ্যমে বাছাইকৃত আইডিয়াসমূহে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অনুদান প্রদান করা হয়। সার্ভিস ইনোভেশন ফান্ডের মাধ্যমে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য মাল্টিমিডিয়া টকিং বুক, অনলাইন পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সর্টিফিকেট, অনলাইন পরিবেশ ছাড়পত্র, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের জন্য মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বয়স যাচাই, বাক প্রতিবন্ধীদের জন্য টকিং ডিভাইসসহ ১৭০টি উদ্ভাবনী ধারণা বাস্তবায়নের জন্য এটুআই কাজ করছে। ‘তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা নয়, বরং শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তি’ এই মূলমন্ত্রকে ধারণ করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, শিক্ষক কর্তৃক মাল্টিমিডিয়া কন্টেন্ট তৈরি, শিক্ষক বাতায়ন, ই-বুক, মনিটরিং ড্যাশবোর্ড ও ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া টকিং বুক নামক মডেলগুলো উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ মডেলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের উপযোগী কন্টেন্ট তৈরি করে ক্লাসে ব্যবহার করছেন। যেখানে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে। ২৩,৩৩১টি মাধ্যমিক ও ১৫,০০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হয়েছে। প্রায় ১,৮০,০০০-এর বেশি শিক্ষক এবং ১,৬৫০ মাস্টার-ট্রেইনার মাল্টিমিডিয়া কন্টেন্ট তৈরি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর গণভবনে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে বই বিতরণ কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রাথমিক স্তরের সকল ডিজিটাল বই এবং দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের হাতে ব্রেইল বুক ও মালটিমিডিয়া টকিং বুক তুলে দেন। কৃষি সম্প্রসারণ সেবাকে ডিজিটাইজ করার মাধ্যমে কার্যকর ও সহজ উপায়ে কৃষকের কাছে সম্প্রসারণ সেবাকে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় এটুআই তৈরি করেছে ‘কৃষি পোর্টাল’। কৃষি পোর্টালটি পাইলটিং হয়েছে এবং খুব শীঘ্র আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশের দার্শনিক ভিত্তি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সুদীর্ঘ সংগ্রামের মধ্যদিয়ে ছিনিয়ে এনেছিলেন স্বাধীনতা—যাঁর চোখে জাতি দেখেছিল স্বনির্ভরতার দৃঢ় অঙ্গীকার। তিনি জাতিকে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। ঠিক তেমনি তার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা জাতিকে উপহার দিয়েছেন তাঁর নির্বাচনী ইস্তেহার ‘দিন বদলের সনদ’। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর ২০২১ সালে বাংলাদেশ কোথায় যাবে তার একটি রূপকল্প ও তিনি দিয়েছেন নির্বাচনী ইস্তেহারে ‘রূপকল্প ২০২১’ নামে। রূপকল্প ২০২১-এর একটি অন্যতম লক্ষ্য ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’, ২০০৮ সালে যেটি ছিল শুধুই স্বপ্ন, আর আজ সেটা বাস্তবতা।
মো. মোস্তাফিজুর রহমান
ছবি/সংযুক্তি
ক্রম
১
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস